স্টাফ রিপোর্টার: প্রায় পঁচিশ বছর ধরে রাজশাহী নগরীর পদ্মাপাড়ে কালাইরুটি বিক্রি করছেন মিনা বেগম। রাজশাহী এসে তার হাতের কালাই রুটি খেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ওই সময় মন্ত্রীর সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন রুটি বিক্রেতা মিনা বেগম। এতে তার বিক্রি বেড়েছে কিছুটা। কিন্তু ফেরেনি ভাগ্য। রোগ-শোক বয়ে আজো একা হাতে সংসারের ঘাণি টেনে চলেছেন পঞ্চাশোর্ধ এই নারী।
মিনা বেগম নগরীর শ্রীরামপুর পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা। তার স্বামীর নাম হাসিবুল ইসলাম (৬০)। সরকারি জায়গায় কোনরকমে ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বাস করছেন মিনা। তার স্বামী হাসিবুল ইসলাম একসময় রিকশা চালাতেন। কিন্তু শরীরে তার বাসা বেঁধেছে জটিল-কঠিন রোগ। গত ১০ বছর ধরে হাটাচলাও করতে পারেননা ঠিকমত।
এই দম্পতি চার ছেলের জনক। বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন তিন ছেলে। মেজো ছেলে রায়হান আলী রানা (২৬) স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাবা-মায়ের সাথেই থাকেন। একসময় নগরীর সাহেববাজার এলাকায় ভাসমান চটপটি ও ফুচকা বিক্রি করতেন রানা। সিটি করপোরেশন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় তার দোকানটি তুলে দেয়। এরপর থেকে তিনিও বেকার।
সংগ্রামী মিনা বেগমের স্বপ্নের শুরুটা ঠিক এমন ছিলোনা। আরসব বাঙালী নারীরমতই সুখি সংসারের স্বপ্ন দেখতেন তিনিও। বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। পরিবারের ইচ্ছায় ওই বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। কৈশর না পেরুতেই স্বামী-সংসার।
বাবার বাড়ি জেলার গোদাগাড়ীর প্রেমতলি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি নগরীর ডিঙ্গাডোবায় এসে ওঠেন মিনা। তার স্বামী তখন থেকেই রিকশা চালাতেন। স্বামীর আয়ে কোনরকমে সচল ছিলো সংসারের চাকা। একে একে তাদের ঘর আলো করে আসে চার ছেলে। কিন্তু অভাবের সংসারে নিত্য টানাপোড়েন লেগেই থাকতো। এই কারণে ছেলেদের পড়ালেখাও করাতে পারেননি।

রিকশা চালিয়ে স্বামী আর সংসারে সামলাতে পারছিলেননা। ওই সময় কিছু একটা করে টিকে থাকার সংগ্রামে নামেন মিনা। প্রায় তিন দশক আগের কথা। শুরু করেন ভাপাপিঠা বিক্রি। বেশ ভালোই চলছিলো বেচাকেনা। কিন্তু সংসার চলছিলোনা।
এরপর একসময় শুরু করেন কালাই রুটি বানানো। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি কালাই রুটি থৈরী করে বিক্রি করছেন পদ্মাপাড়ে। এক পর্যায়ে স্বামী অসুস্থ হয়ে রিকশা চালানো ছেড়ে দেন। এরপর সংসারের দায়দায়িত্ব এসে যায় তার কাঁধে। এরপর থেকেই সংসার চলছে মিনা বেগমের একার আয়ে।
এখন নগরীর সিএন্ডবি মোড় সংলগ্ন পদ্মাপাড়ের গাছ তলায় পলিথিন টাঙিয়ে কালাই রুটি তৈরী করেন মিনা। পাশেই সরকারী বড় কর্তাদের বাংলো। বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি থেকে শুরু করে বড় অফিসাররা তার হাতের রুটি খান। রুটি খান শিক্ষার্থী এমনটি রিকশা চালকও গাছতলাতে বসেই তৃপ্তি করে কালাইরুটি খেয়ে যান লোকজন।
মিনা বেগেমের হাতের এককটা স্পেশাল কালাই রুটির রুটির দাম ৩০ টাকা। আর সাধারণ রুটি বিক্রি হয় ২০ টাকায়। বেগুন ভর্তা, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতার চাটনি দিয়ে রুটি পরিবেশন করেন মিনা বেগম। ভোর ৬টা থেকে শুরু করে রাত ৯টা পর্যন্ত জ্বলে তার চুলা।
রাজশাহীতে এসে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মিনা বেগমের হাতে বানানো কালাইরুটি খান। সেই স্বাদ তিনি ভুলতে পারেননি। দুই বছরপর ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর আমতলায় বসে আবারো মিনা বেগমের কালাই রুটির স্বাদ নেন মন্ত্রী।

সেই দিনের কথা আজো মনে পড়ে মিনা বেগমের। তিনি জানান, সেদিন ভোরবেলা তিনি রুটি বানাচ্ছিলেন। সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে চার-পাঁচজন রুটি খাচ্ছিলেন। পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। ফিরে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন-আমি কি এখানে রুটি খেতে পারি? সামনে বসা লোককজন তাকে ডেকে রুটি খেতে বসালেন। রুটি খেয়ে যাবার সময় ওই ব্যক্তি ২ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। তিনি আগন্তুককে চিনতেই পারেননি।
পরে আরেক দিন তিনি এলেন। সেই দিনও রুটি খেলেন তিনি। ওই সমসয় তিনি তাকে চিনতে পারেন। তিনি ওবায়দুল কাদের। ওই সময় মন্ত্রীর কাছে বেকার ছেলের জন্য চাকরি চান। এরপর মন্ত্রী তার সামনে থেকে বসে থেকেই ছেলের চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে রাজশাহীর জেলা প্রশাসককে ফোন দেন। জেলা প্রশাসকও চাকরির আশ^াস দেন।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পিওন ও নািইটগার্ড পদে তার ছেলে আবেদন করেন। কিন্তু চাকরি আর হয়নি। যাবার সময় তাকে ওবাইদুল কাদের নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন। বহু চেষ্টা করেও নেই নম্বরে সংযোগ পাননি। সংযোগ পেলে হয়তো ছেলের চাকরিটা হয়ে যেতো। তার পরিবারটিও রক্ষা পেতো।

তিনি বলেন, ওই সময় গাছতলায় বসে মন্ত্রীর কালাই রুটি খাবার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন লোকজন। এখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন রুটি খেতে আসেন। এতে আগের চেয়ে বিক্রিও বেড়েছে। অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন কি না। তিনি জানান-চাকরি এখনো হয়নি। হয়তো একদিন হবে। তিনি আশায় বসে আছেন।
মিনা বেগমের রুটির দোকানে টুকটাক সহয়তা করেন তার স্বামী হাসিবুল ইসলাম। অসুস্থতায় এনেবারেই নুয়ে পড়েছেন তিনি। মিনা বেগমের ভাষ্য, গত দশ বছর ধরে তার স্বামী অসুস্থ। এখন অবস্থা আরো খারাপ। ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও লিভারেও সমস্যা আছে। তার দুটি কিডনিই নষ্ট। মাসে অন্তত: সাত-আট হাজার টাকার ওষুধ লাগে।
চিকিৎসায় খরচ হয় মোটা টাকা। রুটি বিক্রির আয়ে সংসার চলেনা। তার উপর স্বামীর চিকিৎসা। যেদিন স্বামীর ওষুধ কেনেন, সেদিন প্রায় না খেয়েই কাটাতে হয় তাদের। ছেলেরা মাঝে মধ্যে কিছু টাকা দেয়। সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগন্য।
করোনা মহামারিতে দুর্বিসহ জীবন কাটিয়েছেন মিনা বেগম। তিনি জানান, করোনাকালেও তিন মাস চুলা জ্বালাতেই পারেননি। যারা তার কাছে নিয়মিত রুটি খেতেন, তারা যোগাযোগ করে কিছু সতায়তা দিয়েছেন। তারপরও অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে দিন পার করেছেন। এখনো রেশ কাটেনি করোনার। আগের চেয়ে লোকজন কমেছে পদ্মাপাড়ে। সেই সাথে বিক্রি কমে গেছে।

এদিকে, দ্বিতীয় দফা যখন মিনা বেগমের দোকানে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তখন তার সাথে ছিলেন জেলার পবা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজা। চাকরির আশায় বহুবার তার কাছেও গিয়েছেন মিনা বেগমের ছেলে রায়হান আলী রানা।
এনিয়ে কথা হয় রানার সাথেও। তিনি বলেন, অনেকবার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে তারা যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই সংযোগ পাননি। তিনি বার বার পবা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার কাছেও গেছেন। গেলেই বলতেন, এবার না হলে পরের বার চাকরি হবে। কিন্তু চাকরি আর হয়নি।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন পবা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজা। তিনি বলেন, তিনি তৎকালীন জেলা প্রশাসককে বলেছিলেন ওই যুবকের চাকরির জন্য। কিন্তু কেনো তার চাকরি হয়নি তিনি জানেননা। তবে ওই সময় মন্ত্রীর কাছে ছেলের চাকরির জন্য পাটকলের এক শ্রমিকও গিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ওই শ্রমিকের ছেলের চাকরি হয়েছে। সুযোগ থাকলে আবারো মিনা বেগমের ছেলের চাকরির জন্য তিনি চেষ্টা করবেন বলেও জানান সঈদ আলী রেজা।
আপনার মন্তব্য