চাঁপাইনবাবগঞ্জ: হাসপাতালের প্রধান ফটকের পাশেই আরেক ফটক। সেটি অবশ্য বেসরকারী রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের। হাসপাতাল এলাকা ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পৌর এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু ক্লিনিক ও রোগ নির্ণয়কেন্দ্র। আর এসব প্রতিষ্ঠানে রোগী টানতে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালে দালালদের কাজে লাগাচ্ছিলেন মালিকপক্ষ।
হাসপাতালের পেছনে ছিলো আরেক ফটক। সেই ফটক গলিয়ে হাসপাতালের ওষুধ ও পথ্য বেরিয়ে যাচ্ছিলো দিনের পর দিন। গত ৮ অক্টোবর ওই ফটক দিয়ে হাসপাতালের ওষুধ নিয়ে যাবার সময় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সারওয়ার জাহান হাতেনাতে ধরে ফেলেন এনামুল হক নামের এক পল্লী চিকিৎসককে।
জিজ্ঞাসাবাদে এনামুল জানান, হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট রবিউল আহমেদ তাকে টিকেট ছাড়াই ওষুধ দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় এইভাবে হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে যাবার কথাও স্বীকার করেন এনামুল।

এনামুলের প্রতিদিন হাসপাতালে আসার কথা স্বীকার করেন ফার্মাসিস্ট রবিউল আহমেদও। তিনি বলেন, এনামুল প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন রোগী নিয়ে আসেন। সেদিনও এক রোগীর জন্য ওষুধ নিয়ে যান। টিকেট পরে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। পূর্বপরিচিত হওয়ায় তিনি ওষুধ দেন। বেরিয়ে যাবার পথে তিনি ধরা পড়েন।
পিছনের ফটকদিয়ে ঢুকে হাসপাতাল চত্বরে অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিলেন স্থানীয় লোকজন। এই ঘটনার পরই স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় পেছনের ফটক।
আরেকটি সূত্র জানাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরেই উপজেলার ৩৩ কমিনিটি ক্লিনিক খেয়াল খুশিমত চালাচ্ছিলেন হেল্থ কেয়ার প্রভাইডাররা (সিএইচসিপি)। নানান অনিয়ম চলে আসছিলো সেখানেও। দায়িত্ব নেয়ার পর সরেজমিনে গিয়ে এসব অনিয়মের প্রমাণ পান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
অনিয়মে জড়িত সিএইচসিপিদের দফায় দফায় কারণ দর্শানো নোটিশ দেন। তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বেশ কঠোর ছিলেন ডা. সারওয়ার।
আর তাতেই কাল হলো ডা. সারোয়ার জাহানের। অপরাধী সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়ে সিএইচসিপিরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন বিভিন্ন দপ্তরে। এরই মধ্যে অভিযোগ তদন্ত করে গেছে জেলার সিভিল সার্জন দপ্তর।
ডা. সারওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে করোনাকালীন সিএইচসিপিরা কোন সুরক্ষা সামগ্রি পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। সবার হয়ে সেই অভিযোগ দিয়েছেন গোমস্তাপুর উপজেলা সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহম্মেদ রুশদি।
অথচ করোনা সংক্রমণের শুরুতেই ২৭ মার্চ উপজেলার ৩৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য ৬৬টি করে পিপিই ও ফেস মাস্ক বুঝিয়ে নেন সিএইচসিপি সিরাজুল ইসলাম।
সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর ৩৩ কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য আরেক দফা ১৬০ পিপিই, ৩৩টি গ্লোভস এবং ৩৩টি মাস্ক গ্রহণ করেন আহমেদ রুশদি নিজেই।

জানতে চাইলে আহমেদ রুশদি দাবি করেন, তারা করোনার শুরুতে এসব সুরক্ষা সামগ্রি চেয়েও পাননি। অভিযোগ দেয়ার পর ডেকে এনে গছিয়ে দেয়া হয়েছে। তার নামে বরাদ্দ দেখানো হলেও তিনি সেগুলো নিয়ে যাননি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দপ্তর জানাচ্ছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারী সহায়তা এবং সরকারী মিলে উপজেলায় পিপিই এসেছে ২ হাজার ৬৮ টি। এর মধ্যে সংশ্লিস্টদের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এক হাজার ৮৫৬ পিস। অবশিষ্ট রয়েছে ২১২টি।
গত ৬ ফেব্রুয়ারী গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন ডা. সারওয়ার জাহান। এরপর একে একে ভেঙে দেন হাসপাতাল কেন্দ্রিক চিকিৎসক-কর্মী-দালাল সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন এই সিন্ডিকেট হাসপাতালে সেবার নামে নৈরাজ্য চালিয়ে আসছিলো।
বরাদ্দ পাওয়া এক হাজার ৮২ গ্লোভ্স বিতরণ হয়েছে এরই মধ্যে। ২ হাজার ১৫৫ ফেস মাস্ক বরাদ্দ পাবার পর বিতরণ হয়েছে ২ হাজার ৮৫টি। ১০০ কেএন ৯৫ মাস্কের মধ্যে বিতরণ হয়েছে ৪০টি। এছাড়া ২৫টি মুভ ক্যাপ, ১১৯টি সু-কভার, ১২টি গাউন এবং ৪৭ ফেস সিল্ড বিতরণ হয়েছে।
আরেকটি অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, হাসপাতালের ওটি, এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি রুম থেকে ৫টি এসি খুলে নিজ অফিস কক্ষ, বাসভবন, ডাক্তারদের রেস্টরুম ও আরএমও’র রুমে লাগিয়েছেন ডা. সারওয়ার জাহান।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এসি নষ্ট হয়ে পড়েছিলো দীর্ঘদিন। তাছাড়া অপারেশন থিয়েটারও বন্ধ। সেগুলো মেরামত করে লাগানো হয় চিকিৎসকদের সুবিধার্থে। এখনো একটি এসি পড়ে রয়েছে স্টোরে।
ডা. সারওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে কোয়ারেন্টাইন ব্যয়ের ৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে চক্রটি। অনুসন্ধানে সেই অভিযোগেরও সত্যতা মেলেনি।
কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, কোয়ারেন্টাইন ব্যয় বাবদ বরাদ্দ এসেছিলো তিন লাখ টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৬২ হাজার ২১০ টাকা খরচ হয়েছে। বাকি হওয়ায় ২ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯০ টাকা ফেরত গেছে।
টেন্ডার ছাড়াই হাসপাতালের আম ফল বিক্রি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও আনা হয়েছে ডা. সারওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউএনও’র প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রক্রিয়া মেনে ৮ হাজার ৭৬০ টাকায় আম ফল টেন্ডার দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সোনালী ব্যাংকের গোমস্তাপুর শাখায় ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারে পুরো অর্থ জমা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়া দেখভাল করেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন।
ডা. সারওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে হাসপাতালের ভেষজ বাগান উজাড়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ সরেজমিনে গিয়ে হাসপাতালের মসজিদের পাশে পাওয়া গেছে ভেষজবাগান। সেখানে রয়েছে ৩৩টি বিভিন্ন প্রজাতির ওষুধি গাছ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের ভেষজবাগান আম্পান ঝড়ে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে মসজিদের পাশে বড় পরিসরে ভেষজ বাগান তৈরী করা হয়েছে। অন্যান্য পরিত্যক্ত জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ফুল বাগান। তবে এই বাগান রয়েছে বেহাল অবস্থায়।
কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, এতোদিন বাগানটি দেখভাল করতেন মালি তরিকুল ইসলাম। কিন্তু তার পদটি হার্বাল এসিস্টেন্ট পদে রুপান্তির হয়। এরপর থেকে তিনি আর বাগান পরিচর্যায় হাত দেননি। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। নতুন করে একজন মালি নিযুক্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন তরিকুল ইসলাম।
তবে তরিকুল দাবি করেন, পুরনো ভেষজ বাগানটি পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসকরে ফুল বাগান করা হয়েছে।

ডা. সারওয়ার জাহান এর বিরুদ্ধে জঙ্গি মামলার আসামি ফারিকুল ইসলাম (জঙ্গিবাহিনী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য এবং ফৌজদারি মামলা চলমান) ও নির্বাচনে অনিয়মের দায়ে আব্দুস সামাদ নামে সাময়িক বরখাস্তকৃত দুই উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসাকে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে স্বপদে বহাল করারও গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করেছেন ডা. সারওয়ার জাহান। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যেতে বাড়তি লোকবলের প্রয়োজন ছিলো। জেলার সিভিল সার্জনের মৌখিক নির্দেশ তাদের চিকিৎসায় সাময়িকভাবে নিযুক্ত করা হয়।
তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন ডা. সারওয়ার জাহান। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতাল কেন্দ্রিক নানান অনিয়ম চলে আসছিলো। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর অপরধি সিন্ডিকেটগুলো একে একে ভেঙে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। জনগণের নির্বঘ্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে তিনি পড়েছেন বেকায়দায়। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করেন ডা. সারওয়ার জাহান।
এবিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, লিখিত অভিযোগ পাবার পর তিনি নিজেই বিষয়টি তদন্ত করেছেন। আরো বেশ কয়েকটি সংস্থা আলাদা তদন্ত করেছেন। ডা. সারওয়ার জাহানকে আপাতত ওএসডি করা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের অপরাধী সিন্ডিকেট ভাঙতে গিয়ে ডা. সারওয়ার জাহান বেকায়দায় পড়েছেন কি না জানতে চাইল সিভিল সার্জন বলেন, সেটিও হতে পারে। সম্ভাব্য সব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদেন্ত শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply