দশ মিনিটের আক্ষেপ রইলো পড়ে

প্রিয় দেশ ডেস্ক: যাত্রী বোঝাই ট্রলারটি তীরে ভীড়ছিল। আর মাত্র মিনিট দশেকের অপেক্ষা। পরে যে যার গন্তব্যে ফিরতেন। কিন্তু সেই অপেক্ষা আর ফুরালনা। আর আগেই বালুবাহী ট্রলারের ধাক্কায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবল ট্রলার। ট্রলারের আগে আগে পাড়ে না ফেরা ঢেউ কষ্ট হয়ে স্পর্শ করল তীর।

মর্মান্তিক এ ঘটনাটি শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লইসকা বিলে ঘটে। শনিবার পর্যন্ত ২২ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু উদ্ধার হয়নি ডুবে যাওয়া ট্রলারটি।

যাত্রীবাহী ট্রলারটি বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ঘাট থেকে জেলা শহরের আনন্দবাজার ঘাটের দিকে আসছিল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে যাত্রীবোঝাই নৌকাটিতে সর্বশেষ যাত্রী উঠেছিল মনিপুর ঘাট থেকে। আর মাত্র ১০-১৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই সেটি পৌঁছে যেত আনন্দবাজার ঘাটে। এটিই ছিল দিনের শেষ খেয়া। অনের জীবনের শেষ খেয়া পারাপার হলো এটি।

ট্রলারডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী আলী আক্তার রেজভী জানান, ট্রলারটি লইসকা বিলে আসার পর বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে যাত্রীবোঝাই ট্রলারটি ডুবে যায়। কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই পানিতে তলিয়ে যান।

লইসকা বিলে নিখোঁজ বড়ভাইয়ের জন্য আহাজারি করা এনামুল ইসলাম জানান, তার ভাই সিরাজুল ইসলাম মনিপুর ঘাট থেকে নৌকাটিতে ওঠেন আনন্দবাজারে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই সেটি ডুবে যায়। এতে তার ভাই নিখোঁজ হন।

বিজয়নগর উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের জহিরুল ইসলাম জানান, নববধূ শারমিন আক্তারকে নিয়ে ট্রলারে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। ট্রলারটি ডুবে যাওয়ার সময় তিনি সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও স্ত্রীকে টেনে তুলতে পারেননি।

এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত কাজ শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমীন ও সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হোসেন রেজা, ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। তারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন।

এ পর্যন্ত ২২ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। নিহতরা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চিলোকূট গ্রামের আব্দুল্লাহর মেয়ে তাকওয়া (৮), চম্পকনগর গ্রামের জহিরুল হক ভূঁইয়ার ছেলে মামুন ভূঁইয়া (২০), গেরারগাঁও গ্রামের মৃত কালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬০), একই গ্রামের জজ মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০), একই গ্রামের জজ মিয়ার মেয়ে মুন্নি (৬), গেরারগাঁওয়ের মৃত আব্দুল হাসেমের স্ত্রী কমলা বেগম, নুরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল রাজ্জাকের স্ত্রী মিনারা বেগম, আদমপুর গ্রামের অখিল বিশ্বাসের স্ত্রী অঞ্জলী বিশ্বাস (৩০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার পৈরতলা গ্রামের আবু সাঈদের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫), একই উপজেলার সাদেকপুর গ্রামের ফুয়াদ হোসেনের ছেলে তানভীর (৮), নরসিংসার গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে সাজিম (৭), ভাটপাড়া গ্রামের জারু মিয়ার মেয়ে শারমিন (১৮), উত্তর পৈরতলা গ্রামের ফারুক মিয়ার স্ত্রী কাজলী বেগম, পৌর এলাকার দাতিয়ারা গ্রামের মোবারক মিয়ার মেয়ে তাসফিয়া মীম (১২), ময়মনসিংহ জেলার খোকন মিয়ার স্ত্রী ঝরনা বেগম (৫৫), আদমপুর গ্রামের পরিমল বিশ্বাসের মেয়ে তিথিবা বিশ্বাস (২), মনিপুর গ্রামের হাজী আব্দুল বারীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৫৮), বাদেহারিয়া গ্রামের কামাল হোসেনের মেয়ে মাইদা আক্তার (৬), ময়মনসিংহ জেলার গোপালপুর গ্রামের শাওনের মেয়ে সাজিদ (৩), বড় পুকুরপাড়ের মো. সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী রুবিনা আক্তার, সোনাবর্ষিপাড়ার আব্দুল বারী ভূঁইয়ার স্ত্রী নুসরাত জাহান, উত্তর পৈরতলা গ্রামের হারিজ মিয়ার মেয়ে নাফসা আক্তার (৩)।

গত শুক্রবার রাতেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে মরদেহ শনাক্তের পর হস্তান্তর করা শুরু হয়েছে স্বজনদের কাছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন জানান, কিছু মরদেহ ঘটনাস্থলে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে বাকি মরদেহ নিয়ে আসা হয়। তাদের স্বজনরা মরদেহ শনাক্ত করার পর হস্তান্তর করা হয়েছে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খান জানান, নিহতদের প্রত্যেকের দাফনের জন্য পরিবারের কাছে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply