টিকা নিলেই মৃত্যু, ভয়ে দূরে গ্রামবাসী!

প্রিয় দেশ ডেস্ক: দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় সংলগ্ন গোলাবাড়ী আদিবাসী গ্রাম। গ্রামটিতে ৩০টির মত পরিবারে প্রায় ১৪০ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্টির লোক বাস করেন। সারাদেশে করোনাভাইরাসের গণটিকা কার্যক্রম চললেও ওই গ্রামে বসবাসরতদের মধ্যে একজনও টিকা গ্রহণ করেননি।

গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, করোনার টিকা দিলে নাকি লোক মারা যায়, পঙ্গু হয়, পায়ে পানি ধরে এ কারনেই তারা টিকা গ্রহণ করেননি। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, কিছু গুজব-অপপ্রচারের কারণে তারা এমন কাজ করেছেন।

দিনাজপুর জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাসে শুরু থেকে গত শনিবার পর্যন্ত নবাবগঞ্জ উপজেলায় মোট ৩২৯ জন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৩২১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে, শনিবার পর্যন্ত উপজেলায় করোনা টিকা গ্রহন করতে ৭৩১৮২ জন নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ২০৯০৩ জন প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণ করেছেন। আর ৭৯৪৩ নিয়েছেন দ্বিতীয় ডোজ।

সরেজমিনে ওই গ্রামের বেশ কয়েক জনের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব সুশিলা মার্ডি কালের কণ্ঠকে বলেন,‘টিকা নিলে মানুষ মারা যাবে সেই ভয়ে আমরা টিকা নেইনি। আমাদের এক আত্মীয় এই কথা বলেছেন।’

রমেষ মার্ডি নামের আরেকজন বলেন,‘আমার কমোরত এমনিতেই ব্যাথা, টিকা নিলে পাও নাকি ফুলে যাবে,আমরা গরিব মানুষ পাও ফুলে গেলে সংসারের কাজ করবে কে। সেই কারনে আমরা টিকা নেইনি।’

গেদু হেমব্রম বলেন,‘আমার একটু শ্বাসকষ্ট আছে। কমোরটা ব্যাথা করে। প্রেস্রাবের সমস্যা হয়। বিভিন্ন কারনে টিকা নেইনি।আর টিকা নিলে নাকি রোগ বাড়ে। মানুষের মুখে শুনেছি।’

শুধু সুশিলা মার্ডি কিম্বা রমেষ মার্ডি,গেদু হেমব্রম নয় তাদের মত ওই গ্রামের বেশ কিছু মহিলা ও পুরুষ মানুষের সাথে কথা হয়েছে। সহজ সরল মানুষগুলোর মাঝে বিভিন্ন অপপ্রচার আর গুজব ছড়ানো হয়েছে। ওই গ্রামটিতে বসবাসরতদের মধ্যে অনেক পরিবার অশিক্ষিত। বেশিভাগ লোক কায়িক শ্রম করেই সংসার চালায়। একারনেই অনেকটা টিকা বিমুখ আছেন তারা।

গ্রামের মানুষের এমন বেহালদশা দেখে ওই গ্রামের স্থানীয় আদিবাসী মার্সাল যুব উন্নয়ন স্পোটিং ক্লাব নামক এক সংগঠন গ্রামবাসীদেরকে টিকার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছেন।

এ উপলক্ষে গত শুক্রবার গ্রামবাসীদের কাছে টিকার গুরুত্ব এবং অপপ্রচারে সাড়া না দেওয়ার জন্য গ্রামের গীর্জা চত্বরে আলোচনা সভার আয়োজন করেন। এতে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. সাদিয়া কাসেম সেফা উপস্থিত থেকে তাদের টিকা বিষয়ে আলোচনা করেন।

সভায় টিকার সুফল সম্পর্কে বিভিন্ন ভাবে তাদের বুঝানোর পর অবশেষে গ্রামের সকলে টিকা নিতে রাজি হন। পরে আয়োজক সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্রামের প্রায় ১শ জনকে ফ্রি টিকার নিবন্ধন করে দেয়া হয়।

জানতে চাইলে গোলাবাড়ি আদর্শ মার্সাল যুব উন্নয়নের কোষাধ্যক্ষ আলমগীর মুর্মু বলেন,‘গ্রামবাসীদের এমন কথা চিন্তা করে তাদের অনেক বুঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তারা কোনভাবেই আয়ত্বে আসেনি। তারা বলেছেন,টিকা নিলে নাকি মানুষ মারা যায়,পা ফুলে যায়, ঘা হয়। বিভিন্ন প্রকার অপপ্রচারের কারণে তারা টিকা নেননি।’

তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি গ্রামের মানুষদের একত্র করেছি। ডাক্তার আপা এসে সবাইকে বুঝিয়েছেন। এতে সবাই টিকা নিতে সম্মত হয়েছে।

নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা.সাদিয়া কাসেম সেফা বলেন, ‘আমরা জেনেছি যে তারা বিভিন্ন অপপ্রচারের কারণে টিকা গ্রহণ করেননি। আমি এসে তাদের কথাগুলো শুনলাম। শেষে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি,গ্রামবাসীরা সবায় টিকা গ্রহণ করবেন বলে কথাও দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে মার্সাল যুব উন্নয়নের সেচ্ছাসেবীরা তাদের ফ্রি নিবন্ধন করে দিচ্ছেন।’

জানতে চাইলে নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো.শাহাজাহান আলী বলেন, তুলনামুলক ওই গ্রামের বাসিন্দারা অনেকটা অশিক্ষিত। তারা কায়িক শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমার উপজেলা স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে পর্যাপ্ত প্রচারণা চালিয়েছি।

তিনি বলেন, তাদের এই আবস্থার কথা শুনে শুক্রবার দুপুরে তাদের স্থানীয় একটি গির্জায় মতবিনিময়ের আয়োজনে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার গিয়েছিল। তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। এরই মধ্যে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে।

Leave a Reply