নাড়ায় উত্তরে বাঁচবে ৩০৬ কোটি টাকার সার

স্টাফ রিপোর্টার: ধান কেটে নেয়ার পর খেতে পড়ে থাকে নাড়া। কারো কাছে এই নাড়া কেবলই জঞ্জাল। গাঁটের পয়সা খরচা করে নাড়া সরিয়ে চাষিরা নামেন পরের আবাদে। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেবল চলতি মৌসুমের আমনের নাড়ায় পুরো উত্তরাঞ্চলে অন্তত: ৩০৬ কোটি টাকার ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি সার সাশ্রয় সম্ভব। যা একেবারেই ধারণার বাইরে কৃষকদের। তাদের সচেতন করা গেলে রাসায়নিক সারের নির্ভরতা কমবে।

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা জেলা ৪টি কৃষি অঞ্চলের আওতায়। কৃষি দপ্তরগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে উত্তাঞ্চলে ১৯ লাখ ৭৫৪ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৪ লাখ ৪ হাজার ৮৫ হেক্টর, বগুড়ায় ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৫০ হেক্টর, রংপুরে ৬ লাখ ১৫ হাজার ৯৯৪ হেক্টর এবং দিনাজপুরে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এখন চলছে রবি মৌসুম। প্রায় পুরো আমনের খেত এসেছে রবিশষ্য চাষের আওতায়।

আরও পড়ুন: বছরজুড়ে কি চাষ, আমনেই সিদ্ধান্ত 

ধানের নাড়ায় সার সাশ্রয় নিয়ে ২০০৩-২০০৪ সাল থেকে গবেষণা করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ। এই বিভাগের প্রধান ও ব্রির মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আমিনুল ইসলামের তত্ত্বাবধানেই এই গবেষণা চলমান।

তিনি বলেন, ১ মণ ধান উৎপাদনে আহরিত হয় দেড় কেজি ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি বা ডিএপি, ২ কেজি এমওপি, ৬০০ গ্রাম জিপসাম এবং ১৪ গ্রাম দস্তা। ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত নাড়া রাখা গেলে প্রতি বিঘা জমিতে ৩ কেজি ইউরিয়া, ১ কেজি ৩৪০ গ্রাম টিএসপি, ৬ থেকে ৮ কেজি এমওপি এবং ১ কেজি ৬০০ গ্রাম জিপসাম যোগ হবে।

এদিকে, চাষি পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপি ২২ টাকা, ডিএপি ১৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকা দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। সেই হিসেবে ২১৫ টাকা সারের খরচা বাঁচবে চাষির। আর হেক্টরে বাঁচবে ১ হাজার ৬১৩ টাকা। এই হিসেবে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ১৯ লাখ ৭৫৪ হেক্টর আমান খেতের নাড়ায় ৩০৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৬ হাজার ২০২ টাকার সারের খরচ বাঁচবে।

আরও পড়ুন: চাষ ছাড়াই সরিষা, দুয়ার খুলল সম্ভাবনার

উত্তরের চার আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের হিসেবে, ২০২২-২০২৩ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৭ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৩ টন ইউনিয়া, ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৮৪০ টন টিএসপি, ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫ টন ডিএপি এবং ৮ লাখ ৮০ হাজার ২৬ টন এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে ।

এরমধ্যে ইউরিয়ার চাহিদা রয়েছে রাজশাহীতে ৫ লাখ ২০ হাজার ৮০৭ টন, বগুড়ায় ৪ লাখ ২২০ টন, রংপুরে ২ লাখ ৭০ হাজার ২৭৫ টন এবং দিনাজপুরে ৪ লাখ ৮ হাজার ৩৭৮ টন। টিএসপির চাহিদা রয়েছে রাজশাহীতে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১৩ টন, বগুড়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ১৯০ টন, রংপুরে ৫৩ হাজার ৩৯১ টন এবং দিনাজপুরে ১ লাখ ৪০ হাজার ২৪৬ টন।

ডিএপির চাহিদা রয়েছে রাজশাহীতে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩১১ টন , বগুড়ায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৭ টন রংপুরে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৯২ টন এবং দিনাজপুরে ২ লাখ ১৮ হাজার ৮৪৫ টন। এছাড়া এমওপির চাহিদা রয়েছে রাজশাহীতে ২ লাখ ৯৮ হাজার ১০৪ টন, বগুড়ায় ২ লাখ ২৪ হাজার ৬০ রংপুরে ৮৪ হাজার ৩০১ টন এবং দিনাজপুরে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬১ টন।

আরও পড়ুন: স্বর্ণাতেই আটকে চাষি, বাড়ছে কেবল ক্ষতি

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রবি মৌসুমে সারের একটি বড় অংশ যায় আলুচাষে। সূত্রমতে, উত্তরাঞ্চলে চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৭ হাজার ৭১৫ হেক্টর, বগুড়ায় ৯৮ হাজার ৯৫ হেক্টর, রংপুরে ৯২ হাজার ৬৭২ হেক্টর এবং দিনাজপুরে ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হতে পারে।

উত্তরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য রবিশষ্য চাষে আমনের নাড়া রাখছেন কৃষক। কিন্তু আলুচাষের বেলায় নাড়া সরিয়ে ফেলছেন পুরোপুরি। বিঘা প্রতি ৪০০ টাকা খরচায় খেতের নাড়া সরিয়েছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষ্ণপুর এলাকার আলু চাষি মঞ্জুর রহমান।

এবার ২৫ বিঘা জমিতে আলুচাষ করেছেন এই কৃষক। তিনি জানান, গত ছয় বছর ধরে তিনি আলু চাষ করছেন। প্রতিবারই চাষের আগে আমন খেতের নাড়া যান্ত্রিক উপায়ে সরিয়ে দেন। নাড়া রাখলে জমি প্রস্তুত করা যায়না। আবার সারি তৈরীতেও সমস্যা হয়। সারির ভেতরে নাড়া থাকলে সারিগুলো ফা঳পা হয়ে পড়ে। ফলে সেচের সময় পানি ঢুকে গাছ মারা যায়।

আরও পড়ুন: দেশে নতুন কলার জাত, কাঁদিতে ধরবে ২০০

নালা ভেঙে যাওয়ায় সেচ দিতে অসুবিধা হয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে নাড়া সরিয়ে ফেলেন তিনি। অনেক সময় আগুন ধরিয়ে খেতেই নাড়া পুড়িয়ে দেন। কাছাকাছি খেতের নাড়া বাড়ি নিয়ে গিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। এলাকার আলু চাষিদের ভাষ্য প্রায় একই।

আলু চাষিদের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে হিসেব করলে, কেবল আলু চাষের সুবিধায় উত্তরের ১৬ জেলার ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমির নাড়া সরিয়ে ফেলছেন কৃষক। নাড়ার সঙ্গে প্রতি হেক্টরে ৪৯২ টাকার প্রায় ২৩ কেজি ইউরিয়া, ২২০ টাকার ১০ কেজি টিএসপি, ৯০০ টাকার ৬০ কেজি এমওপি এবং প্রায় দেড়শ টাকার ১২ কেজি জিপসাম হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হিসেবে পুরো উত্তরাঞ্চলে ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমপিতেই হারাচ্ছে ৪৪ কোটি ৭৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।

আলু খেত থেকে নাড়া সরিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুর অঞ্চল প্রধান শাহ আলম। তিনি বলেন, আমন মৌসুমের পর বিশেষ করে আলু চাষের জন্য নাড়া রাখেননা কৃষক। নাড়াতে সার সাশ্রয়ের বিষয়টি কৃষকদের কৃঝিয়েও লাভ হয়না। তবে রোবো মৌসুমে পুরো নাড়াই কৃষক জমিতে চাষ দিয়ে মিলিয়ে দেন।

আরও পড়ুন: মালবেরিতে স্বপ্ন বুনছেন সোহেল 

কিছু কৃষক আলু চাষে নামার আগে খেতে নাড়া পুড়িয়ে দেন বলে নিশ্চিত করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চল প্রধান শামছুল ওয়াদুদ। তিনি বলেন, ধানের নাড়া জমিতে মিশিয়ে দেয়া গেলে জৈব পদার্থ যুক্ত হয়। নাড়া পোড়ালেও মিউরেট অব পটাশ যুক্ত হবে।

কিন্তু নাড়া পুড়াতে গিয়ে মাটিতে বসবাস করা নানান ক্ষুদ্র অনুজীব মারা পড়ে। এ ক্ষেত্রে ভালো পরামর্শ হলো- চাষ দিয়ে নাড়া মাটির সাথে মিলিয়ে দেয়া। এটি সম্ভব হলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কিছুটা হলেও কম হতো।

ব্রি রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ফজলুল ইসলাম বলেন,লাগাতার চাষের ফলে দিন দিন মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা গবেষণা করছি, কি করে মাটিতে জৈব্য পদার্থ ফিরিয়ে দেয়া যায়। এরই অংশ হিসেবে উচ্চফলনশীল আমন ধানের জাত ব্রি ধান-৮৭ উদ্ভাবন করা হয়েছে।

এই ধানের গাছ অনেক লম্ব। ধান কাটার সময় লম্বা নাড়া রেখে কাটতে হবে। নাড়ায় যথেষ্ট পরিমানে পটাশিয়াম, ফসফেট, নাইট্রেজেন ও জিপসাম রয়েছে। ধান কেটে নেয়ার পর নাড়া রেখে সেগুলো মাটিয়ে মিশিয়ে দিলে জমিতে এসব জৈব পদার্থের ফিরে যায়। এতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। কৃষকের সারের খরচাও বাঁচে।

Leave a Reply