স্টাফ রিপোর্টার: কৃষকের ক্ষেত থেকে পাইকারি বাজার, পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে সবজির দামের আকাশ পাতাল ব্যবধান। কৃষক পর্যায় থেকে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি দামে পাইকারি বাজারে সবজি বেচাকেনা হচ্ছে। আবার পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ। এতে কৃষকের হাত থেকে পাইকারি বাজারে আসতে সবজির দাম বাড়ে প্রায় চারগুণ!
বছরজুড়েই সবজিতে সরগরম থাকে রাজশাহীর খড়খড়ি বাইপাস। রাজশাহীর অন্যতম এই পাইকারি সবজির মোকাম থেকেই সবজি কেনেন বিক্রেতারা। এখানে যত না ভিড় থাকে খুচরা দোকানির, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভিড় জমান পাইকারি ক্রেতারা। রাজশাহী নগরী তো বটেই জেলার প্রায় সব উপজেলায় এখান থেকেই সরবরাহ হয় বিভিন্ন রকমের কাঁচা পণ্য।
শুক্রবার (১৭ মার্চ) সরেজমিনে দেখা যায়, দিনের কর্মব্যস্ততা শুরুর আগেই সরগরম নগরীর অদূরে পবা উপজেলার খড়খড়ি বাইপাস বাজার। পাইকারি বিক্রেতা ও ক্রেতাদের হই-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে পুরো বাজার। ক্ষেত থেকে সবজি তুলে বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছেন অনেক চাষি। আবার অনেকে ট্রাকে করে রাজধানীর উদ্দেশ্যে সবজি নিয়ে যেতে পার করছেন ব্যস্ত সময়।
কিন্তু কৃষি পণ্য নিয়ে এই যে এত আয়োজন, তাতে ভাগ্য খুলে না উৎপাদনকারী চাষির। কৃষকের উৎপাদিত প্রতিটি পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে তিন থেকে চারবার হাত বদল হয়। প্রত্যেক হাত বদলের সময়ই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায় পণ্যের দাম। কৃষকের কাছ থেকে ব্যাপারী, বেপারীর কাছ থেকে পাইকার, পাইকারের কাছ থেকে সর্বশেষ খুচরা দোকানির কাছে পৌঁছায় এসব কাঁচা পণ্য।
কৃষক যদি কোনো পণ্যের দাম পান ১০ টাকা, তবে ভোক্তাকে তা কিনতে হয় কমপক্ষে ৩০ টাকা বা আরও বেশি দামে। অজুহাত হিসেবে দেখানো হয় পরিবহন আর জ্বালানির খরচ বৃদ্ধিকে। হাত বদলে সবজির দাম আবার কয়েক গুণ দাম বেড়ে যায়। তবে দাম বাড়লেও কিছু যায় আসে না চাষিদের। লাভের টাকার পুরোটাই ঢুকছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পকেটে বলে জানা চাষিরা।
গোদাগাড়ীর রামচন্দ্রপুর থেকে খড়খড়ি বাইপাসে মিষ্টি বরই বিক্রি করতে এসেছিলেন আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, বাগান থেকে বিক্রির জন্য প্রায় ১০ মণ বরই এনেছি। অর্ধেক বরই বিক্রি করা হয়েছে। বাকি অর্ধেকও বিক্রি হবে। আজ প্রতি মণ বরই ১ হাজার থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি করছি। আমাদের কাছ থেকে যারা নিয়ে যায় সবাই খুচরা বিক্রি করে। তারা ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে।
পবা উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামের চাষি শফিকুর রহমান পেয়ারা বিক্রি করতে এসেছিলেন বাজারে। তিনি বলেন, বাগানের যা পেয়ারা হয়েছে বেশিরভাগ এখানেই বিক্রি করেছি। এক বছরে দেড় বিঘা জমিতে প্রায় দেড়শ মণ পেয়ারা হয়েছে। শুরুর দিকে প্রতি মণ ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা বিক্রি হতো। এখন কমতে কমতে ৭০০-৮০০ টাকায় নামছে। যারা কিনছে তারা বিক্রি করবে কেজি ৩০-৪০ টাকায়। ঢাকায় যারা নিয়ে যায় তারা একটু বেশি দাম দেয়, বাগান থেকেই নিয়ে যায়।
গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ি হাট থেকে আসা তৈয়ব আলী বলেন, আর যাই বলেন, একসাথে এত বরই বিক্রি করা যায় না। এখানে আসলে অল্প সময়েই সব বিক্রি করা যায়। লাভ কম হোক, বিক্রি তাড়াতাড়ি হয়। এতে আমাধের জন্য অনেক ভালো। বাসায় আরো কাজ করতে পারি।
বগুড়া থেকে আলু এনে পাইকারি বিক্রি করেন রাজশাহীর খড়খড়ি বাইপাস এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, বগুড়ায় ১২ টাকা বা সাড়ে ১২ টাকা কেজি দরে আলু কিনতে হয়। যারা চাষি তারা প্রতি কেজিতে ১১ টাকা করে পায়। খুব বেশি লাভেরও সুযোগ নেই, এখানে আমরা ১৩ টাকা থেকে সাড়ে ১৩ টাকা দরে দিচ্ছি। যারা খুচরা বিক্রেতা তাদের একটু বেশি লাভ হয়, তারা ১৫-১৬ টাকা করে বিক্রি করে।
নাটোর সদরের লালন সজনে বিক্রি করতে এসেছেন বাজারে। তিনি বলেন, এখানে যত সজনে বিক্রি হয় বেশিরভাগই খুলনা থেকে আনা। আমিও খুলনা থেকে আনি। ৯০-১২০ টাকা কেজিতে কিনতে হয় আমাদের। আর পাইকারি বিক্রি করি ১০০-১৫০ টাকা কেজি। আমাদের থেকে যারা কিনে তারা আরও ২০-৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করে।
নগরীর বিনোদপুর বউবাজারের খুচরা বিক্রেতা মহসিন আলীর সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আজ ৯০ টাকা কেজি সজনে কিনলাম, ১১০ টাকা তো কেজিতে নিতেই হবে। এভাবে সব সবজির দামেই ২০-৩০ টাকা বাড়তি নিতে হয়। আমাদেরও তো চলতে হবে।
মিজানুর রহমান নামের এক আলু বিক্রেতা বলেন, চাষিরা যদি বেশি না ১৫ টাকা করে কেজি আলু বিক্রি করতে পারতো তাহলে তাদের অনেক ভালো হতো। কিন্তু ১১-১৩ টাকার বেশি তারা পাচ্ছে না। তানোর থেকে প্রতিদিন ৫০ মণ আলু আনি। খুব বেশি না সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই টাকা লাভে বিক্রি করতে হয়। বাঘা, চারঘাট, গোদাগাড়ী, পুঠিয়াসহ সব জায়গার মানুষ পাইকারি নিতে আসে। দাম বেশি নিলে তো আসবে না। আমাদের লাভ কম হলেও সেল বেশি হয়।
কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সবজির দাম কয়েক গুণ বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিক্রেতা সবুজ হোসেন বলেন, শীত-বর্ষা উপেক্ষা করে প্রতিদিন সবজি নিয়ে আসতে হয়। চাষিদের থেকে দু-চার টাকা বেশি না নিলে আমাদের সংসার চলবে কিভাবে? খুব বেশি তো নিচ্ছি না।
এ বিষয়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, আমরা ভোক্তা ও চাষি পর্যায়ে মূল্য ব্যবধান কমাতে আগেও নানা উদ্যোগ নিয়েছি। রোজার আগে আবারও বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ খাদ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বসব।
Leave a Reply