[email protected] মঙ্গলবার, ৫ই ডিসেম্বর ২০২৩, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩০

বরেন্দ্রর পথে প্রান্তরে

ভ্রম

প্রকাশিত:
৫ অক্টোবার ২০২৩, ১৯:০২

টিকইল আল্পনা গ্রাম, নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ছবি: সংগৃহিত

বরেন্দ্র উত্তরবঙ্গের একটি জনপদ। ঐতিহাসিকদের মতে− বর্তমান রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ নওগাঁ, নাটোর বগুড়া, রংপুর দিনাজপুর বরেন্দ্র এলাকা। গন্তব্য ঠিক করলাম সিল্ক সিটি রাজশাহী পুঠিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কাঁচাগোল্লার দেশ নাটোর হয়ে পাবনা। পাঁচ দিনের এ ভ্রমণে উত্তরবঙ্গের মানুষের সরলতা, তাদের আতিথেয়তা সবকিছুই পেয়েছি  

অনেকদিন ধরেই কোথাও যাব যাব করে যাওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় এটা নিয়েই দ্বিধা, শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো উত্তরবঙ্গের একাংশ ঘুরে আসলে মন্দ হয়না! সিদ্ধান্ত ছিল একাই ঘুরবো এবার, কিন্তু যাওয়ার দুই দিন আগে হঠাৎ বন্ধু ফয়সাল জুড়ে এসে বসল সেও নাকি যাবে!

উত্তরবঙ্গ হলো বাংলাদেশের উত্তর দিকে অবস্থিত একটি ভৌগোলিক অঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরকে একত্রে বলা হয় উত্তরবঙ্গ। উত্তরবঙ্গের একাংশ ভ্রমণের উদ্দেশে এবার যাত্রা করলাম রাজশাহীর দিকে। 
 

গন্তব্য সিল্ক সিটি রাজশাহী

ভোর সাড়ে ৫টায় বেরিয়ে পড়লাম। মনে হলো বহুদিন পর সতেজ বাতাস অনুভব করছি। ভোরের বাতাসে একটা সতেজতা আছে কিন্তু ইদানীং সকাল সকাল ঘুম ভাঙেই না। স্টেশন থেকে কপোতাক্ষ এক্সপ্রেসের দুটি টিকেট কেটে উঠে পড়লাম! সকাল সোয়া ৬টায় ট্রেন ছাড়ল। পুরা বগিতে শুধু আমরা দুজন বলা যায়! টিকটিক করতে করতে দুপুর ১টায় ট্রেন পৌঁছে গেল রাজশাহী! শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই, হয়তো বহুদিন পর ভ্রমণ করার আনন্দ!

স্টেশন থেকে নেমেই রাজশাহীর লোকাল বয় সাদিককে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আজকের গন্তব্যে! রাজশাহী শহরের সব থেকে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হলো এর পরিষ্কার রাস্তা, যা দেখেই আপনার মন ভরে যাবে!

রাজশাহীর আরেকটা মজার বিষয় হলো, এখানে এমন কোনো বাড়ি চোখে পড়বে না যে বাড়িতে আমগাছ নেই! রুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, হজরত শাহ মখদুম রুপশ (রহ.)-এর মাজার, পদ্মার পাড় এসব ছিল আজকের গন্তব্যস্থল! দুপুর থেকে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে রাতে চলে এলাম বন্ধু সাদিকের বাসায় আশ্রয়ের জন্য!

পুঠিয়ার পথে পথে
 

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়লাম, আজকের গন্তব্যস্থল বরেন্দ্র জাদুঘর, বাঘা মসজিদ, পুঠিয়া! পুঠিয়ার জমিদার/রাজারা প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা এবং ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্নের জন্য বিভিন্ন স্থাপত্য কাঠামো ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মন্দির নির্মাণ করেন, যা আজও কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে।

পুঠিয়ায় অবস্থিত অধিকাংশ মন্দিরে পোড়ামাটির ফলক স্থাপিত আছে। এখানকার পুরাকীর্তির মধ্যে পাঁচআনি রাজবাড়ী বা পুঠিয়া রাজবাড়ী, চারআনি রাজবাড়ী ও ১৩টি মন্দির রয়েছে। পুঠিয়ার প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে ১৪টি স্থাপনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে।

পাঁচআনি জমিদারবাড়ির আশপাশে রয়েছে গোবিন্দ মন্দির, ছোট আহ্নিক মন্দির, ছোট শিবমন্দির, দোলমন্দির, বড় শিবমন্দির ও জগন্নাথ/রথ মন্দির। চারআনি জমিদার কর্তৃক বড় আহ্নিক, ছোট গোবিন্দ ও গোপাল মন্দির নামে পরিচিত একই অঙ্গনে পাশাপাশি তিনটি মন্দির আছে। মহারানীর স্নানঘাট থেকে বৃষ্টিস্নাত গোবিন্দ মন্দির বেশ দর্শনীয়।

রাজশাহী শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিখ্যাত পুঠিয়া রাজবাড়ির সবচেয়ে কাছে এ মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরটি মূলত ইটনির্মিত, বহির্দেয়ালে রয়েছে পোড়ামাটির চিত্রফলক। এসব চিত্রফলকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।

নবাবদের এলাকায়
 

নামেই যেহেতু নবাব, বুঝতেই পারছেন আমরা আজ চলে এসেছি নবাবদের এলাকায়! আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল ছোট সোনা মসজিদ, তাহখানা কমপ্লেক্স, চামচিকা/ ধনিয়াচক মসজিদ, টিকইল আলপনা গ্রাম। চাঁপাইয়ের সব মসজিদের ইতিহাস, কারুকার্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই! কি সুন্দর সব স্থাপনা! আমাদের সব মসজিদ দেখা শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হই টিকইল অর্থাৎ আল্পনা গ্রামের উদ্দেশে।

এ গ্রামটিতে মনে হয় শুধু সুখের বাতাস বয়ে থাকে। সবুজ-শ্যামল বিল, গাছপালার মাঝে মাঝে কি সুন্দর মাটি দিয়ে তৈরি বাড়ি! গ্রামের সরল জীবনযাপন! এ গ্রামের সবকিছুই মুগ্ধ করবে আপনাকে। তবে এ গ্রামের আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে দুর্গাপূজার সময়! গ্রামের প্রতিটি বাড়ি সে সময় আলপনায় মেতে ওঠে।

কাঁচাগোল্লার দেশে!
 

আজ আমরা যাচ্ছি কাঁচাগোল্লার দেশে! কাঁচাগোল্লা খেতে খেতে দেখব নাটোরের রাজবাড়ি, উত্তরা গণভবন, পাটুল বা হালতি বিল। নাটোর এসে ঢুকে পড়লাম ৩০০ বিঘার বিশাল রাজবাড়িতে, কি সুন্দর জায়গা! এখানে আপনি দেখতে পারবেন রাজা-বাদশাহদের সময়কার স্থাপনা, আর কাটাতে পারবেন একটি সুন্দর দিন!

এরপর গণভবন দেখে আমরা দুপুর ২টার দিকে চলে গেলাম পাটুল বা মিনি কক্সবাজার যেটা হালতি বিলের একটি অংশ! বিলের মাঝ দিয়ে মাইলের পর মাইল রাস্তা ডুবে আছে পানিতে। কি সুন্দর দৃশ্য আর এত স্বচ্ছ পানি, দেখে লোভ সামলে না পেরে ঘণ্টাখানেক গোসল করে নিলাম মিনি কক্সবাজারে। বিকালের রোদবৃষ্টিতে ঘুরে নিলাম নাটোরের ছোট্ট শহরটি আর খেলাম নাটোরের ঐতিহ্যবাহী কাঁচাগোল্লা।

ঐতিহ্যমণ্ডিত পাবনা
 

আজ আমাদের উত্তরবঙ্গের একাংশের শেষ দিন! রাজশাহী থেকে বিদায় নিয়ে সকাল ১০টায় পৌঁছে গেলাম পাবনা!  বিকাল ৩টার ভেতর আমরা পাবনা মানসিক হাসপাতাল, শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম, তাড়াশ ভবন দেখে রওনা হয় রূপপুরের উদ্দেশে।

শেষ বিকালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, রেলওয়ে জাদুঘর দেখে আমাদের ভ্রমণের সমাপ্তি হয়। পাঁচ দিনের ব্যস্ত ভ্রমণে আমরা অনেক কিছু দেখেছি। নতুন সংস্কৃতি, নতুন জায়গা, উত্তরবঙ্গের মানুষের সরলতা, তাদের আতিথেয়তা সবকিছুই পেয়েছি আমরা।

যেভাবে যাবেন
 

আকাশপথ : শাহমুখদুম বিমানবন্দর। রাজশাহী শহরের নিকটবর্তী নওহাটায় অবস্থিত বিমানবন্দরটি রাজধানী ঢাকার সাথে রাজশাহীকে আকাশ পথে যুক্ত করেছে।

সড়কপথ : রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় প্রতি আধঘণ্টায় একটি করে বাস ছাড়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা বাস সার্ভিসগুলোর অন্যতম: হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল, দেশ ট্রাভেলস, শ্যামলী পরিবহন। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে ন্যাশনাল ও দেশ ট্রাভেলসের এসি বাস যায় রাজশাহী। 
 

রেলপথ : সিল্ক সিটি, ধূমকেতু ও পদ্মা এক্সপ্রেস, রেলপথে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাবার অন্যতম আধুনিক আন্ত:নগর রেল ব্যবস্থা। সিল্কসিটি ঢাকা থেকে দুপুর ২.৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় এবং রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে সকাল ৭.৩৫ মিনিটে।
 

(রাজশাহী থেকে সড়কপথে আপনার বাজেট অনুসারে স্থানীয় যেকোন পাবলিক অথবা রিজার্ভ করা পরিবহনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও পাবনায় ভ্রমণ করতে পারবেন)

 

বরেন্দ্র এক্সপ্রেস/এফএস


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর